উচ্চ মাধ্যমিকের নতুন সিলেবাসে মানচিত্র অবলম্বনে রচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেক বছর একটি করে থাকে। সংসদের প্রদত্ত নমুনা প্রশ্নপত্রে “সবুজায়ন বনাম নগরায়ন” এটি দেওয়া রয়েছে, সেটিরই একটি সম্পূর্ণ নমুনা উত্তর তোমাদেরকে দেওয়া হলো।
৬.১ নিম্নে প্রদত্ত মানস-মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা করো। ১০
- সবুজ ধ্বংসের পরিণতি
- নগরায়ণের কারণ
- সবুজায়ন বনাম নগরায়ণ
- পরিবেশ রক্ষায় গাছ
- প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট
সবুজায়ন বনাম নগরায়ন: মানস মানচিত্র অবলম্বনে রচনা
অবতরণিকা
"সেই তো সুদিন, যবে লেগেছিল গাছের বুকে ফুল,
সেই তো আনন্দ, যবে বয়ে গেছিল বাতাসে বনভূমির কূল।"
এই পঙ্ক্তিগুলো প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যকে তুলে ধরে, যেখানে গাছ, পাখি, বাতাস আর নীল আকাশ এক অনবদ্য সুর সৃষ্টি করে। কিন্তু আজকের আধুনিক নগরায়নের ফলে সেই সুর যেন কর্কশ হয়ে উঠছে। একদিকে উন্নয়নের হাতছানি, অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া সবুজের মর্মবেদনা—এই দ্বন্দ্বেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ।
নগরায়ন আমাদের প্রগতির প্রতীক, মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক অপরিহার্য অংশ। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা প্রকৃতির থেকে কী ছিনিয়ে নিচ্ছি? আমরা কি হারিয়ে ফেলছি সেই সবুজ, যে আমাদের ছায়া দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন দেয়, আমাদের বেঁচে থাকার মূল উপাদান সরবরাহ করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সবুজায়ন বনাম নগরায়নের মূল দোলাচলে।
নগরায়নের কারণ: সভ্যতার আবরণ নাকি প্রকৃতির পরাজয়?
উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা মানবজাতি শহরের দিকেই ছুটছে। নগরায়নের পেছনে রয়েছে কিছু মৌলিক কারণ—
- অর্থনৈতিক বিকাশ: কলকারখানা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নগরায়ন অপরিহার্য। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে শহরের প্রসার ঘটাতে হয়।
- জনসংখ্যার চাপ: গ্রাম থেকে শহরে মানুষের অভিবাসনের ফলে নগর গড়ে উঠছে দ্রুতগতিতে।
- পরিকাঠামোগত উন্নয়ন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, যানবাহনের সুবিধা পাওয়ার জন্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।
- আধুনিক জীবনযাত্রার আকর্ষণ: উন্নত প্রযুক্তি, ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা, আধুনিক আবাসন নগর জীবনের মূল চাহিদা হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ কি বলেছিলেন?
"আমি একদিন পৃথিবীর সবুজ পথের ধুলো হয়ে যাবো..."
কিন্তু সেই সবুজ পথ কি আর থাকবে?
সবুজ ধ্বংসের পরিণতি: হারিয়ে যাওয়া স্বর্গোদ্যান
নগরায়নের অগ্রযাত্রার ফলে প্রকৃতির ওপর যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে, তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
- প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অবনতি:
“পৃথিবীকে ভালোবাসো, কারণ এটাই আমাদের একমাত্র বাসস্থান।” – কার্ল সাগান
বনভূমি ধ্বংসের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। - বন্যপ্রাণীদের বিলুপ্তি:
বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। হরিণ, বাঘ, হাতি—এরা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। - পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি:
“যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসতে না পারো, তবে সে তোমাকে ফিরিয়ে দেবে শুধুই শূন্যতা।”
কার্বন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে, ফলে শ্বাসকষ্ট ও নানা অসুখ বাড়ছে। - ভূগর্ভস্থ জলস্তরের পতন:
কংক্রিটের জঙ্গলে ভূগর্ভস্থ জল স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। গাছ মাটির জল শোষণ করে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ধরে রাখে, কিন্তু নগরায়নের ফলে জল ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় গাছের গুরুত্ব: সবুজের ডাক
গাছ শুধু শীতল ছায়া দেয় না, এটি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
- অক্সিজেনের যোগানদাতা:
“গাছ লাগানো মানেই জীবন লাগানো।”
গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। - বায়ুদূষণ কমায়:
শহরের ধুলাবালি, কারখানার দূষণ প্রতিরোধে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। - প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে:
গাছ লাগানোর মাধ্যমে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।
সবুজায়ন বনাম নগরায়ন: সমাধান কোন পথে?
নগরায়নের সঙ্গে সবুজায়নের একটি সুষম সমন্বয় প্রয়োজন। পরিকল্পিত নগরায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি টেকসই উন্নয়ন মডেল গড়ে তুলতে হবে।
- শহর বনায়ন: নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে শহরে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
- সবুজ স্থানের সংরক্ষণ: পার্ক, উদ্যান, বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে।
- দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির ব্যবহার: কলকারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
- ‘একজন এক গাছ’ নীতি: প্রত্যেক নাগরিকের উচিত অন্তত একটি গাছ লাগানো এবং তার যত্ন নেওয়া।
উপসংহার: সবুজায়ন ও নগরায়নের সহাবস্থান
"আমি বৃষ্টির কাছে রেখে যাবো আমার সবুজ অভিমান"
নগরায়ন অস্বীকার করা সম্ভব নয়, কিন্তু প্রকৃতির বিনিময়ে অগ্রগতির চিন্তা আত্মঘাতী। মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। তাই আমাদের উচিত এমন এক নীতি গ্রহণ করা, যেখানে নগরায়ন এবং সবুজায়ন পাশাপাশি এগিয়ে যেতে পারে।
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -