'ভাবসম্মিলন' - মৈথিল কবি বিদ্যাপতি
⏺️ রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর প্রশ্নোত্তর : ( প্রশ্নমান – ৫)
❝চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।❞ – কার, কোন মন্দিরে মাধব কিভাবে উপস্থিত হয়েছেন? মাধবের উপস্থিতিতে বক্তার কি মানসিক প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে? ২+৩
উত্তর 👉🏻 মৈথিল কবি বিদ্যাপতির ❝ভাব সম্মিলন❞ কবিতার এই পঙক্তিটি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক অতি পরিচিত ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ পংক্তি। এই পঙক্তির মধ্য দিয়ে কবি বিদ্যাপতি তার ভক্তিমূলক ভাবকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।
☆ কবিতার নায়িকা অর্থাৎ শ্রীমতি রাধারানীর হৃদয় মন্দিরের কল্পনাতে তার প্রেমিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা মাধব উপস্থিত হয়েছেন। এখানে ‘মন্দির’ শব্দটি শুধুমাত্র একটি স্থানের নাম নয়। এটি রাধার হৃদয়ের প্রতীক। তিনি কৃষ্ণকে তাঁর হৃদয়ে সর্বদা উপস্থিত রাখতে চান, তাই ‘মন্দির’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
☆ রাধার মানসিক প্রতিক্রিয়া :→ বৃন্দাবনে শ্রীমতি রাধাকে রেখে মাধব শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাতে চলে গেলে শ্রীমতি রাধা কৃষ্ণ বিরহে একান্ত কাতর হয়ে পড়ে। সর্বদাই ❝হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ❞ বলে হতাশায় নিমজ্জিত হন। কৃষ্ণ বিনে সমগ্র জগত তমসাবৃত হয়ে ওঠে তার কাছে। চন্দ্রলোকের মাধুর্যতা মানুষকে মুগ্ধ করে কিন্তু শ্রী রাধিকার কাছে চন্দ্রকিরণের মাধুর্য বিষাদের করুন সুর বয়ে আনে। এই বিষাদের মধ্যেই হঠাৎ একদিন শ্রীমতি রাধারানীর মন মন্দিরের কল্পনাতে শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি হওয়ায় এই উপস্থিতিতে রাধারানী মাধবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সীমাহীন আনন্দের অধিকারী হয়েছেন। আর সেই আনন্দের কথা তার সখীদের জানিয়ে বলেছেন, ❝কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।❞ এই পঙক্তিতে রাধা তাঁর সখিকে বলছেন যে, তিনি সর্বদা কৃষ্ণের সঙ্গে থাকতে চান। কৃষ্ণের উপস্থিতি তাঁকে অসীম আনন্দ দেয়। রাধা কৃষ্ণকে তাঁর হৃদয়ের মন্দিরে রাখতে চান, এটা ইঙ্গিত করে যে তাঁদের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রয়েছে। রাধার কৃষ্ণের প্রতি অগাধ ভক্তির পরিচয় দেয়। তিনি কৃষ্ণকে তাঁর জীবনের সর্বস্ব মনে করেন।
এই পঙক্তিতে রাধা তাঁর প্রেমিক কৃষ্ণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি চান যে, কৃষ্ণ সর্বদা তাঁর হৃদয়ে বাস করুন। এই পঙক্তিটি রাধার আধ্যাত্মিক ও ভক্তিময় প্রকৃতিরই প্রমাণ।
ভাবসম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য পদটিতে রাধার আনন্দের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা কর। ২+৩
উত্তর 👉🏻 ভাবসম্মিলন মানে একসাথে অনেকগুলো ভাবকে মিলিয়ে একটা কবিতা লেখা। এই কবিতায় কবি বিভিন্ন ধরনের ভাব প্রকাশ করেন, যেমন— আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহ ইত্যাদি। বিদ্যাপতির ‘ভাবসম্মিলন’ কবিতাতেও আমরা এমনই একাধিক ভাবের মিশেলে রাধার আনন্দকে দেখতে পাই। কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী রাধা মাথুর-বিরহে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে কল্পনাই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। এই আস্থাকে বলা হয় ভাবসম্মিলন।
☆ রাধার আনন্দের চিত্র :— বিদ্যাপতির এই কবিতায় রাধা তাঁর প্রেমিক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আনন্দে মগ্ন। রাধিকা-কৃষ্ণের মিলনের আনন্দকে অসাধারণ ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘ বিরহের পর মিলনে রাধিকার আনন্দময় অবস্থা কবির কল্পনায় মুখরিত।
❝কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।❞ – এই চরণে রাধা তাঁর সখিকে বলছেন যে, তাঁর আনন্দ কত বড়! তিনি চিরদিন কৃষ্ণের মন্দিরেই থাকতে চান। এখানে রাধার অসীম আনন্দ ও কৃষ্ণ প্রতি ভক্তির পরিচয় মেলে।
❝পাপ সুধাকর যত দুখ দেল। পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।❞ – এই চরণে রাধা বলছেন যে, কৃষ্ণের দর্শন তাঁর সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। অর্থাৎ, কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ।
❝আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।❞ – এই চরণে রাধা বলছেন যে, যদি তাঁর কাছে কেউ যদি সমস্ত ধনসম্পদ দিয়ে বিনিময়ে তার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে চাই, তবুও তিনি কৃষ্ণকে অন্য কোথাও পাঠাবেন না। এখানে রাধার প্রেমের গভীরতা ও নিঃস্বার্থতা প্রকাশ পেয়েছে।
বিদ্যাপতির ‘ভাবসম্মিলন’ কবিতায় রাধার আনন্দকে দেখা যায় কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে, তাঁর প্রেমের গভীরতায় এবং সকল দুঃখ ভুলে যেতে পারার ক্ষমতায়। এই কবিতাটি রাধার অসীম ভালোবাসা ও আনন্দের এক সুন্দর চিত্র উপস্থাপন করেছে।
❝আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।❞ –কোন প্রসঙ্গে শ্রীমতি রাধিকা এই উক্তি করেছেন? এই উক্তির মাধ্যমে শ্রীরাধিকার কৃষ্ণ প্রেমের নিবিড়তা কতখানি প্রকাশ পেয়েছে? ২+৩
উত্তর 👉🏻 বিদ্যাপতির কবিতায় শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকার প্রেমের যে অসাধারণ চিত্র আমরা পাই, তা সত্যিই মন মুগ্ধ করে। তাঁদের প্রেমের গভীরতা এবং নিষ্ঠা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। ❝আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।❞ এই পঙক্তিটি রাধিকার হৃদয়ের ভাবকে খুবই স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। রাধিকা এই উক্তি করেছিলেন যখন কৃষ্ণ তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন এবং তিনি কৃষ্ণের বিরহে অতিষ্ঠ ছিলেন। এই উক্তির মাধ্যমে রাধিকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর কাছে কৃষ্ণের প্রেম সারা পৃথিবীর সমস্ত ধনসম্পত্তি থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। এই উক্তির মাধ্যমে রাধিকার কৃষ্ণ প্রেমের নিবিড়তা খুবই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলছেন যে, যদি তিনি কৃষ্ণকে ফিরে পান, তাহলে সারা জীবন তাঁর পাশেই থাকবেন। রাধিকার প্রেম সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। তিনি কৃষ্ণের কাছ থেকে কিছু আশা করেন না। তিনি শুধু কৃষ্ণের পাশে থাকতে চান।
☆ রাধিকার প্রেমের নিবিড়তা :– রাধিকার এই উক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, তাঁর কৃষ্ণ প্রেম কতটা নিবিড়। তাঁর প্রেম অবিচল, নিঃস্বার্থ এবং অসীম। তিনি কৃষ্ণকে হারাতে ভয় পান। তাঁর কাছে কৃষ্ণই সবকিছু। রাধিকা তাঁর হৃদয় মন্দিরে কল্পনাতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আনন্দ তাহার সখীদের কাছে বর্ণনা করছেন। রাধিকা বলছেন যে, তাকে যে যতই কষ্ট-ব্যথা-দুঃখ দিক না কেন, কৃষ্ণের মুখ দেখলে তাঁর সব দুঃখ বিলিন যায়। রাধিকা কৃষ্ণকে তাঁর শীতের ওড়না, গ্রীষ্মকালের শীতল বাতাস, জলে ভেসে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নৌকা এবং বৃষ্টির ছাতা বলে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ হল, কৃষ্ণ তাঁকে সব সময় রক্ষা করেন।
বিদ্যাপতির কবিতায় রাধিকার কৃষ্ণ প্রেমের যে চিত্র আমরা পাই, তা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। রাধিকার এই উক্তিগুলি তাঁর প্রেমের গভীরতা এবং নিষ্ঠাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। তাঁর প্রেম অবিচল, নিঃস্বার্থ এবং অসীম।
❝শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা। বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।❞ – কার সম্পর্কে এই কথা বলা হয়েছে? উদ্ধৃত চরণ দুটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর। ২+৩
উত্তর 👉🏻 বিদ্যাপতির এই ❝ভাবসম্মিলন❞ পদ্যে ❝শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা। বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।❞ এই দুটি চরণে যাঁর কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণ। রাধিকা তাঁর প্রেমিক কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলছেন।
☆ চরণ দুটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য :–
❝শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।❞ –এই পঙক্তিতে রাধিকা বলছেন যে, শীতের কঠিন সময়ে ওড়না যেমন ভাবে তীব্র শীতের হাত থেকে রক্ষা করে এবং গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে শীতল বাতাস যেভাবে তৃপ্তি দেয় বা রক্ষা করে ঠিক তেমনি কৃষ্ণ তাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রক্ষা করেন।
❝বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।❞ –এই পঙক্তিতে রাধিকা বলছেন যে, বর্ষাকালে প্রচন্ড বৃষ্টির সময় যেমন প্রয়োজন হয় ছাতা আর নদী বা সমুদ্র পথে যাত্রা করার জন্য যেমন নৌকা বা জাহাজের প্রয়োজন হয় ঠিক তেমনই শ্রীমতি রাধারানীর জীবনের প্রতিমুহূর্তে তার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে প্রয়োজন।
এই দুটি চরণের মধ্য দিয়ে রাধিকার কৃষ্ণ প্রেমের গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি কৃষ্ণকে সর্বদা নিজের পাশে চান। তাঁর কাছে কৃষ্ণ শুধু একজন প্রেমিক নন, তিনিই তাঁর সবকিছু। তিনি কৃষ্ণের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। শীতের ঠান্ডা হোক বা বৃষ্টির জোর, তিনি কৃষ্ণ ছাড়া একা থাকতে চান না। তিনি কৃষ্ণকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন এবং তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
❝ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি। সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।❞ – কখন ‘বরনারি’কে ডেকে কবি বিদ্যাপতি কি বলেছেন? কবিতায় ‘বরনারি’র সম্পর্কে কি জানা যায় তা সংক্ষেপে লেখ।
উত্তর 👉🏻 চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির ভাবসম্মিলন কবিতায় দীর্ঘ বিরহের পর মিলনের আনন্দে শ্রীমতি রাধিকা আত্মহারা। কারণ, তার প্রিয়তম কৃষ্ণ তার কাছে ফিরে এসেছে। অনেক দিন ধরে তারা একজন আরেকজনকে দেখতে পায়নি। কৃষ্ণ হারা হয়ে তিনি যতখানি কষ্ট পেয়েছিলেন প্রিয় মাধবের মুখদর্শন করে রাধিকা তার থেকেও বেশি সুখ উপলব্ধি করেছেন। এই প্রসঙ্গে কবি বিদ্যাপতি ‘বরনারি’অর্থাৎ শ্রীমতি রাধাকে বলেছেন যে,- ❝শুন বরনারি। সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।❞ অর্থাৎ ভালো মানুষের দুঃখ অল্প দিনের জন্য স্থায়ী হয়। আর কয়েকদিনের মধ্যেই সুখ ফিরে আসে।
☆ ‘বরনারি’ বা রাধার সম্পর্কে কি জানা যায়? —
১) অনুরাগী প্রেমিকা :– রাধা কৃষ্ণের প্রতি অগাধ ভালবাসা পোষণ করেন। তিনি কৃষ্ণকে প্রিয়তম হিসেবেই নয়, প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তিনি বলছেন যে, যদি তাঁর কাছে কেউ যদি সমস্ত ধনসম্পদ দিয়ে বিনিময়ে তার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে চাই, তবুও তিনি কৃষ্ণকে অন্য কোথাও পাঠাবেন না।
২) বিরহের যন্ত্রণা :– কৃষ্ণের বিরহে রাধা অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেন। তিনি কৃষ্ণকে না পেয়ে প্রচণ্ড কষ্ট পান।
৩) মিলনের আনন্দ :– কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর রাধার আনন্দে কোনো সীমা থাকে না। তিনি কৃষ্ণের মুখ দেখে চরম সুখ অনুভব করেন।
৪) অবিচল ভক্তি :– কৃষ্ণের প্রতি রাধার ভক্তি অবিচল। তিনি কৃষ্ণকে সর্বস্ব মনে করেন।
৫) সহজ স্বভাব :– রাধার স্বভাব খুবই সহজ ও সরল। তিনি নিজের ভাব খুব সহজেই প্রকাশ করেন।
বিদ্যাপতির “ভাবসম্মিলন” কবিতায় শ্রীমতি রাধারানীর চিত্রটি একজন আবেগী, ভক্তিময় এবং সহজ স্বভাবের নারীর। তাঁর ভালবাসা, বিরহ এবং মিলনের অনুভূতিগুলো কবিতায় খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -