“আড্ডা” প্রবন্ধটি বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা এবং এটি তাঁর “পঞ্চতন্ত্র” গ্রন্থের অন্তর্গত। এই প্রবন্ধে লেখক আড্ডার সংজ্ঞা, বাঙালির আড্ডার বৈশিষ্ট্য, অন্যান্য দেশের আড্ডার তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং তাঁর কাইরোবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—স্মৃতিচারণ, রসবোধ, ব্যঙ্গ, এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সংমিশ্রণ।
‘আড্ডা’ প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু
আড্ডার সংজ্ঞা ও বাঙালির আড্ডার স্বাতন্ত্র্য
লেখকের মতে, আড্ডা হলো শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, এটি বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সৃষ্টিশীলতার উন্মেষ এবং সমাজ ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে এবং কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা উদ্দেশ্যের সীমাবদ্ধতা থাকে না। বাঙালির আড্ডার প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- এটি চায়ের দোকান, কলেজ স্ট্রিট, চণ্ডীমণ্ডপ, জমিদারবাড়ি, অফিসের বাইরে বসে।
- রাজনীতি, সাহিত্য, প্রেম, দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস—সবকিছুই এখানে আলোচনার বিষয় হতে পারে।
- বাঙালির আড্ডার স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রাণপ্রাচুর্য অন্য কোনো জাতির মধ্যে তেমনভাবে দেখা যায় না।
কিন্তু লেখক মনে করেন, “বাড়ির আড্ডায় ‘মেল’ মেলে না”। কারণ—
- যাঁর বাড়িতে আড্ডা বসে, তাঁর প্রতি বাকিরা স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যান।
- গৃহিণী কখনো কখনো আড্ডাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেন।
- বাড়ির পরিবেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কম থাকে।
অন্যান্য দেশের আড্ডার সঙ্গে তুলনা
অনেক বাঙালির ধারণা, আড্ডা কেবল বাঙালির একচেটিয়া সংস্কৃতি। কিন্তু লেখক প্রমাণ করেছেন, বিশ্বের অনেক দেশে আড্ডার প্রচলন আছে, তবে তার ধরন আলাদা। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখান—
- সিন্ধুর “পাল্লা” মাছ, নর্মদার “মদার” মাছ এবং পদ্মার “ইলিশ” মাছ এক হলেও রান্নার ধরন ভিন্ন।
- তেমনি, আড্ডা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকলেও, বাঙালির মতো রসিয়ে উপভোগ করার ক্ষমতা অন্যদের নেই।
কাইরোর কাফে ও আড্ডার অভিজ্ঞতা
লেখক বিদেশ বিভুঁইয়ে যখন কাইরোতে থাকতেন, তখন প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় “কাফে দ্য নীল”-এ যেতেন। এখানে তিনি নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন এবং আড্ডার এক নতুন সংস্কৃতি আবিষ্কার করেন।
কাইরোর আড্ডার বিশেষত্ব:
- এটি কখনো কারও বাড়িতে বসে না, বরং নির্দিষ্ট কাফেতে বসে।
- কেউ কাউকে তোয়াজ করে না, সবাই সমান।
- আড্ডা গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখে।
- কেউ বাড়ি যাবার নাম করে না, গিন্নীর ঝামেলা নেই।
- খাবার ও পানীয়র মাধ্যমে আড্ডা আরও মজাদার হয়।
এই কাফেতে লেখকের পরিচিত ব্যক্তিরা ছিলেন—
- রমজান বে ও সজ্জাদ এফেন্দি (খাঁটি মিশরীয় মুসলমান)
- ওয়াহহাব আতিয়া (কপ্টিক খ্রিস্টান, ফারাওদের বংশধর)
- জুনো (ফরাসি কবি, যিনি আরবী কবিতাও লিখতেন)
- মার্কোস (গ্রীক ব্যবসায়ী)
এখানে নানা বিষয়ে আলোচনা চলত—রাজনীতি, সাহিত্য, প্রেম, ব্যবসা, জীবনদর্শন ইত্যাদি।
কাইরোর তামাক সংস্কৃতি ও লেখকের অভিজ্ঞতা
কাইরোর কাফেতে বসে তামাক সেবন ছিল এক অনন্য শিল্প। লেখক একবার কাইরোর বিখ্যাত সুগন্ধী তামাকের স্বাদ নেন এবং তার স্মৃতি বহু বছর পরেও অমলিন থেকে যায়।
তিনি গবেষণা করে জানতে পারেন, সুগন্ধী ইজিপশিয়ান সিগারেটের উৎপত্তি ও রসায়ন। এটি মূলত গ্রীক তামাকের সঙ্গে মিশরের সুগন্ধী মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যা বিশ্বের সেরা সিগারেটগুলোর মধ্যে একটি। লেখক মজা করে বলেন—
"বেহেশতের বর্ণনায় এই তামাকের কথা নেই কেন? থাকলে তো কেউ নরকে যেতে চাইত না!"
মিশরীয়দের “বুট-বালিশ” সংস্কৃতি
মিশরীয়দের অন্যতম বড় শখ ছিল জুতো পালিশ করা। কাফেতে ঢুকলেই জুতো পালিশওয়ালা ছেলেরা সালাম ঠুকত এবং নিয়মিত আড্ডাবাজরা তাদের জুতো পালিশ করাতেন।
এছাড়া, কাফের ওয়েটাররা প্রত্যেক গ্রাহকের অভ্যাস সম্পর্কে ভালো জানত—
- কে কীভাবে কফি পান করেন,
- কে কখন চিঠি লেখেন,
- কার জন্য ফোন আসে, সবকিছু তারা মনে রাখত।
প্রেম, রাজনীতি ও জীবনের নানা প্রসঙ্গ
আড্ডায় প্রায়ই প্রেম নিয়ে আলোচনা হতো। একবার লেখক প্রেমপত্র লিখতে বসেছিলেন, কিন্তু তখন জানতে পারেন, তার প্রেমিকা আসলে সিনেমার গেটে অপেক্ষা করছেন! তখন আড্ডার সবাই হেসে ওঠেন এবং এই বিষয়টি ঘিরে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। এই আড্ডায় তর্ক-বিতর্ক গড়ে ওঠে কোন দেশের রমণী সবচেয়ে সুন্দরী? এ বিষয়ে লেখকের উত্তর ছিল, “এনারা আছেন, ওনারাও আছেন”—অর্থাৎ সৌন্দর্যের বিচার আপেক্ষিক এবং নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
উপসংহার
“আড্ডা” প্রবন্ধটি শুধু কথোপকথনের নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, রসনা, জীবনধারা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক অপূর্ব রসায়ন। লেখক দেখিয়েছেন, কেবল বাঙালিরাই নয়, বিশ্বজুড়ে মানুষ আড্ডা দেয়, তবে বাঙালির আড্ডা সবচেয়ে প্রাণবন্ত, যুক্তিপূর্ণ, মজাদার এবং সর্বজনীন। কাইরোর কাফেতে বসে লেখকের আড্ডার অভিজ্ঞতা তাঁকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যা তাঁর স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -