“আজব শহর কলকেতা” প্রবন্ধটি বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত একটি ব্যঙ্গধর্মী রচনা, যা তাঁর জনপ্রিয় প্রবন্ধ সংকলন “পঞ্চতন্ত্র” থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে লেখকের স্বভাবসিদ্ধ রম্য রচনা, তীক্ষ্ণ রসবোধ, সামাজিক পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনবদ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এই প্রবন্ধে লেখক এক বৃষ্টিভেজা দিনে কলকাতার রাস্তায় এক ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে বিস্মিত হন এবং এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাত্যাভিমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তাঁর প্রাঞ্জল ভাষা, কৌতুকপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সূক্ষ্ম ব্যঙ্গবোধ প্রবন্ধটিকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে, যা “পঞ্চতন্ত্র” গ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে বিবেচিত।
আজব শহর কলকেতা: বিষয়বস্তু ও সারমর্ম
কলকাতার আজব চরিত্র
লেখক ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন যে কলকাতা একটি আজব শহর। যদিও তিনি বহুদিন ধরে এখানে বাস করছেন, সত্যিকারের “আজব” অভিজ্ঞতা খুব কমই হয়েছে। একদিন, যখন তিনি এক প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। তাঁর কাছে ছাতা বা বর্ষাতি নেই, ট্রামে ওঠার শক্তিও নেই, বাস বা ট্যাক্সিতে ওঠার ইচ্ছাও নেই। ফলে তিনি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং হঠাৎ চোখে পড়ে এক আশ্চর্য জিনিস—“ফ্রেঞ্চ বুক শপ” নামক একটি দোকান।
ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে বিস্ময়
এমন এক শহরে, যেখানে বাংলা ও ইংরেজির বইও তেমন চলে না, সেখানে শুধুমাত্র ফরাসি বই বিক্রির দোকান দেখে লেখক বিস্মিত হন। তিনি ভাবতে থাকেন, হয়তো কোনো ফরাসি পথ হারিয়ে এখানে এসে দোকান খুলেছে, অথবা দোকানের আড়ালে অন্য কিছু বিক্রি হয়! কৌতূহলবশত তিনি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সত্যিই দেখেন, এখানে শুধু ফরাসি বইয়ের সম্ভার।
দোকানের অভ্যন্তরীণ চিত্র
লেখক লক্ষ্য করেন, দোকানে হলুদ ও সাদা মলাটের গাদা গাদা বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কিছু বই সাজানো, কিছু এলোমেলোভাবে রাখা। বইগুলোর এই বিশেষ সাজানো ভাব দেখে লেখকের মনে হয়, দোকানদার হয়তো বাঙালিদের মতোই বই রেখেছেন—যে বই চেনে, সে সহজেই খুঁজে নিতে পারবে, কিন্তু যে চেনে না, সে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।
ফরাসি মহিলার আবির্ভাব ও ভাষাগত সমস্যা
এরপর লেখকের সামনে আসেন এক ফরাসি মহিলা, যিনি হাসিমুখে তাঁকে স্বাগত জানান এবং সরাসরি ফরাসিতে কথা বলেন। লেখক প্রথমে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু মেমসাহেব সেটি বুঝতে পারেন না। এতে লেখক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ফরাসি ভাষার প্রতি ফরাসিদের জাত্যাভিমান এত প্রবল যে তারা ইংরেজি বলতে চায় না। বাধ্য হয়ে লেখক তাঁর সামান্য জানা ফরাসি দিয়ে কথা বলা শুরু করেন।
ভাষাগত দ্বন্দ্ব ও মেমসাহেবের প্রতিক্রিয়া
লেখকের টুকটাক ফরাসি শুনে মেমসাহেব খুব খুশি হন এবং প্রশংসা করেন। আলাপচারিতার মধ্যে জানা যায়, দোকানটি আসলে মেমসাহেবের নয়, বরং তাঁর এক বান্ধবীর। বান্ধবী অনুপস্থিত থাকায় তিনি এখানে বসে শুধুমাত্র ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার করছেন।
বাঙালির নতুন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ
এ সময় এক বাঙালি যুবক দোকানে ঢুকে “কমার্শিয়াল আর্ট” সম্পর্কিত বই খোঁজে। লেখকের মনে আনন্দ জাগে, কারণ এটি প্রমাণ করে যে বাঙালিরা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করছে। এরপর লেখক নিজেও একটি আকর্ষণীয় বই খুঁজে পান—ন্যুরনবর্গ ট্রায়ালের দলিল থেকে লেখা হিটলারের চরিত্র বিশ্লেষণ।
লেখকের উপলব্ধি
প্রবন্ধের শেষে লেখক উপলব্ধি করেন, কলকাতা সত্যিই এক আজব শহর, যেখানে প্রতিদিনই নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে। ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন—সবকিছুই একে অন্য সব শহর থেকে আলাদা করে তোলে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -