বাংলা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর
📘 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা 📘
বাংলা সাহিত্যের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান উল্লেখ কর।
📘 👉🏻 বাংলা গদ্য যাদের সহযোগিতায় পরিকাঠামো লাভ করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠান ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। 1800 খ্রীঃ 4মে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গদ্যের সুবর্ণযুগ শুরু হতে থাকে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেই বাংলা গদ্যের জন্ম হয় বলে, এই প্রতিষ্ঠানকে বাংলা গদ্যের শ্রুতিকাগার বলে।
● ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক গোষ্ঠি এবং তাদের প্রন্থাবলী :–
- (ক) রামরাম বসুর ‘রাজাপ্রতাপাদিত্য’ (1801 খ্রি.)
- (খ) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (1802 খ্রি.)
- (গ) উইলিয়াম কেরির ‘ইতিহাস মালা’ (1812 খ্রি.)
- (ঘ) হরপ্রসাদ রায়ের ‘পুরুষ পরীক্ষা’ (1815 খ্রি.)
১) উইলিয়াম কেরি :– কলেজের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অধ্যাপক হলেন উইলিয়াম কেরি। তিনি কলেজে যোগ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন পাঠ্যপুস্তকের অভাব। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন এই কলেজের অধ্যক্ষ। বিদেশী হলেও বাংলা ভাষা শিক্ষাই ছিল তার গভীর কৌতুহল। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ছাত্রদের জন্য উপহার দিয়েছিলেন দুটি মূল্যবান গ্রন্থ– ‘ইতিহাস মালা’ ও ‘কথোপকথন’।
২) রামরাম বসু :– ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে যাঁর গ্রন্থ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়, তিনি হলেন রামরাম বসু। এই কলেজে যোগাদান করে তিনি প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন ‘রাজা প্রতাপাদিত্য’ এটি বাংলা অক্ষরে ছাপা সর্বপ্রথম মৌলিক গ্রন্থ।
৩) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার :– ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যাপক রূপে যিনি পরিচিত তিনি হলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। তিনি ছিলেন পন্ডিত, সাহিত্যিক এবং ভাষাশিল্পী। এই কলেজের বাংলা এবং সংস্কৃত বিভাগে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক। মাসিক দুশোটাকা বেতনে তিনি এই কলেজের অধ্যাপনার কাজ শুরু করেছিলেন। এই কলেজ থেকে
তিনি মোট চারটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, সেগুলি হল– ১৮০২ সালে ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ১৮০৮ সালে ‘হিতোপদেশ’ ও ‘রাজাবলি’, ১৮১৭ সালে ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ এবং ১৮৩৩ সালে (তার মৃত্যুর পর) ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’।
পরিশেষে বলতে হয়, ফোট উইলিয়াম কলেজে লেখক গোষ্ঠির হাতে বাংলা গদ্যের প্রথম সূচনা হয়েছিল। এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একদিকে যেমন পদ্য রচনার প্রয়াস দেখা দিয়েছিল, তেমনি এই সময় থেকে শুরু হল বিট্রিশ শাসকদের সঙ্গে লেখকদের মসীযুদ্ধ।
বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখ কর।
📘 👉🏻 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায় নবজাগরনের শুকতারা। সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথে পা দিয়ে তিনি অসামান্য প্রতিভার বলে আধুনিক জীবনজিজ্ঞাসার কর্মমুখর প্রাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য শুধু ভারতবর্ষে নয় সমগ্র প্রাচ্য দেশেই তিনি প্রথম জাগ্রত মানুষ বাংলা। সাহিত্যে তার অবদান অসামান্য।
● গ্রন্থাবলী :— রাজা রামমোহন রায় প্রধানত সমাজ ও ধর্ম সংস্কার উদ্দেশ্যে পুস্তিকা লিখেছিলেন। তিনি 1815-1830 পর্যন্ত মোট 15 বছরের মধ্যে অন্তত ৩০ টি বাংলা পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল— ‘বেদান্তপ্রন্থ‘ (1815 খ্রি.), ‘বেদান্তসার‘ (1815 খ্রি.), ‘বিভিন্ন উপনিসদের অনুবাদ‘ (1815-19 খ্রি.), ‘ভট্টাচার্যের শহিদ বিচার‘ (1817 খ্রি.), ‘গোস্বামির শহিদ বিচার‘ (1818 খ্রি.), ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক-নিবর্তক সংবাদ‘ (1818 খ্রি.), ‘ব্রাহ্মসেবধী‘ (1821 খ্রি.), ‘গৌড়িয় ব্যাকরন‘ (1833 খ্রি.) প্রভৃতি গ্রন্থগুলি উল্লেখযোগ্য।
রামমোহনের কৃতিত্ব :– রাজা রামমোহন ধর্ম সংস্কারক এবং সমাজ সংস্কারক। তার সময়ে সামাজে যে অবক্ষয় দীঘা গিয়েছিল তা দূরকরার জন্য তিনি যেন মসীযুদ্ধে শুরু করে দিয়েছিলেন। সাহিত্যসৃষ্টি করার বাসনা তাঁর ছিল না। সমাজ গড়ে তোলায় ছিল তার সংকল্প। এপ্রসঙ্গে তার অনুদিত ভক্ত ঈশ্বরগুপ্ত বলেছেন,–
"দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন। তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদ ...... অতি সহজে ..... কষ্টরূপে প্রকাশ পায়িত।"
পরিশেষে বলতে হয়, রাজারামমোহন রায় বাংলা সাহিত্যের সার্থক গদ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি ঠিকই, কিন্তু আমাদের বিচারে তিনি বাংলা গদ্যের পথিকৃৎ। তিনি বাংলাদেশ, বাংলাভাষায় ও বাঙালির জ্ঞান সমৃদ্ধিতে যে নবযুগের সূচনা করেন, তার জন্য বাঙালিরা তার অবদান চিরদিন সগৌরবে বহন করবে। কারণ, তিনি নবজাগরনের ‘শুকতারা’, বাংলাগদ্য রচনার ‘অগ্রদূত’।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অবদান আলোচনা কর।
📘 👉🏻 বাংলার কাব্যশুরুতে প্রথমযুগের অর্থাৎ ঊনিশ শতকের বঙ্গে যিনি রেনেসাঁস মন্ত্রের উদগাঁতা, যিনি বাংলা সাহিত্যের মরাগাঙে ভরা জোয়ার এলেছিলেন তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চ্যাতের মিলনের কবি মিল্টন ভাবশিষ্য শ্রীমধুসূদন। বাংলা কাব্য সাহিত্যে তার অবদান অসামান্য।
● মধুসূদন রচিত কাব্যগ্রন্থ :– মধুসূদন রচিত বাংলার কাব্যগ্রন্থগুলি হল–
- তিলকত্তমা সম্ভব (1860 খ্রী.)
- মেঘনাদবধ কাব্য (1861 খ্রী.)
- ব্রজাঙ্গনা কাব্য (1861 খ্রী.)
- বীরাঙ্গনা কাব্য (1862 খ্রী.)
- চর্তুদশপদী কবিতাবলী (1866 খ্রী.)
মধুসূদন কাব্যপ্রতিভা :—
‘তিলকত্তমা সম্ভব’ কাব্যের প্রথম সর্গের মধুসূদন অমিত্রাক্ষ ছন্দের ব্যবহার করেছেন। এই মহাকাব্যের দেবদ্রোহী সুন্দ ও উপসুন্দ এই দুইভাইকে নিধন করার জন্য তিলকত্তমার আর্বিভাবের কল্পনা করা হয়েছিল।
মধুসূদন কাব্যপ্রতিভার উজ্জ্বল উদাহরন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। এই কাব্যখানি শুধুমাত্র আলোংকারি মেঘনাদ মহাকাব্য নই। এটি হল উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী মানসের জীবনবেদ। মহাকাব্য রামায়নের কাহিনী অবলম্বনে নয়টি সর্গ সম্পূর্ণ। এই কাব্যে মধুসূদনের প্রতিভা উজ্বল হয়ে উঠেছে। এই কাব্যে বীরবাহুর নিধন সংবাদ থেকে মেঘনাদের হত্যা ও প্রমিলার চিতার অহন বর্ণিত হয়েছে।
‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ মধুসূদনের আশ্চর্য সৃষ্টি এটি একটি গীতিকবিতাধর্মী রচনা। মধুসূদন এই কাব্যে রাধাকৃষ্ণের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তিনি এই কাব্যে নানা স্থানে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা বর্ণনা করেছেন।
পরিশেষে বলতে হয়ে, মাইকেল মধুসূদন বাংলা কাব্য সাহিত্যের এক অপার বিস্ময়ও। তিনি যেন নিজের বক্ষপাঞ্জরের আগুন জ্বালিয়ে তারই আলোকে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিরূপণ করেছিলেন। নীলকন্ঠের মতো দুঃখবেদনা, হতাশার বিষাক্ত প্রাণী ও শিখন করে শ্রীমধুসূদন গৌড়জনের যে অমৃতময় কাব্য রচনা করেছিলেন তার অমিয় মূল্য তাকে বাংলা সাহিত্যের চিরস্মরণীয় করে রাখবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এর রচয়িতা কে? বাংলা সাহিত্যে তার অবদান আলোচনা কর।
"কে বলে ইশ্বরগুপ্ত ব্যপ্ত চরাচর
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।"
📘 👉🏻 সংবাদ প্রভাকর রচয়িতা ঈশ্বরগুপ্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম যুগের এক উল্লেম যোগ্য যোগ্য কবি প্রতিভা নামে সুবিদিত ড. সুকুমার সেন তার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই— “বাংলা সাহিত্যের খোলা হওয়ার বাতায়ন খুলিয়াছিল সাময়িক পত্র”। বাংলা সাহিত্যের এই উষা মুহূর্তে কবি নায়ক যিনি, তিনি হলেন ঈশ্বরগুপ্ত, যাকে ‘Minor poet’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে।
● পরিচয় :– একথা স্বীকার্য যে, ঈশ্বরগুপ্ত বাংলা কাব্যে নতুনের সাড়া জাগিয়েছেন এবং তিনি পরবর্তীকালে বহু কবি ও সাহিত্যিকের আচার্য। গুপ্ত কবি জানতেন যে পুরাতন জঞ্জালরাশিতে রং ধরবে না। এখন চাই নতুন বিষয়, নতুন রূপায়ণ। ঈশ্বর গুপ্ত এই চিন্তায় ব্রতী হলেন।
● ঈশ্বরগুপ্তের কবিতার কয়েকটি পর্যায় :– ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাকে কয়েকটি পর্যায়ে বিধৃত করা যায়–
- নৈতিক ও পারমার্থিক কবিতা
- সমাজ প্রীতি মূলক কবিতা
- প্রেম রসাত্মক কবিতা
- তুচ্ছ বিষয় বস্তু অবলম্বনে কবিতা
- বিবিধ প্রসঙ্গ ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা
গুপ্ত কবির রঙ্গ-ব্যঙ্গ-মূলক কবিতা :–
প্রথমত,– গুপ্তকার রঙ্গ ব্যঙ্গ বা হাস্যরসের গোবাক্ষ লন্ঠনের আলোকরশ্মি বিকিরণ করে জীবনকে দেখেছেন। কাব্যে তিনি হাসি হৈ হুল্লোরের বান ছুটিয়েছেন। বাঙালির নিজস্ব দৈনন্দিন জীবন পালাপার্বন উৎসব আয়োজনের সামাজিক রীতি নীতি সবই তার কাব্যে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত,– গুপ্ত কবির আরো একটি বৈশিষ্ট্য যে, তাঁর ছিল একটি গীতিপ্রবণ মন। ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য কল্পনা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমা লঙ্ঘন করেনি। তাঁর কাব্যে ঢেঁকিশালা আর রন্ধনশালা কলহ পরোয়ানা রমণীর বাস্তব চিত্র পাওয়া গেছে। গুপ্ত কবি গ্রাম বাংলার সাধারণ নারির বাস্তবচিত্র অঙ্কন করেছেন।
তৃতীয়ত,– গুপ্ত কবির আরো একটি বৈশিষ্ট্য তার স্বদেশপ্রীতি। দেশকে ভালোবেসেই ঈশ্বরগুপ্ত দেশবেরী। দেশ ও সমাজের অন্তমূলে যেখানে ভন্ডামী, মিথ্যাচার, ত্রুটিপুন কিছু দেখেছেন সেখানেই রঙ্গব্যঙ্গের পিকচারী দিয়ে দ্রাবক রস ছড়িয়েছেন। ঈশ্বর গুপ্তের কয়েকটি কবিতায় ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে যে, তিনি কেমন রঙ্গব্যঙ্গের কবি ছিলেন। যেমন বিলাতি মহিলা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন,–
"বিড়ালক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে আহা তাই রোজ রোজ কতরোজ ফুটে।"
ফিরিঙ্গি শিক্ষায় উদ্ধত বাঙালি মেয়ের প্রতি বিদ্রূপ করে বলেছেন,–
"যত ছুঁড়িগুলি তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে তখন এ.বি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে।
পরিশেষে বলতে হয় যে, ঈশ্বরগুপ্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গনে আবির্ভূত হয়ে চিরকালের মতো অন্তহিত হয়ে গেলেন। তার কারন হিসাবে বলা যায় যে, গুপ্ত কবির কোনো “Message of Life” ছিল না। তবে একথা ঠিক যে, বাংলা সাহিত্যে গুপ্তকবির অবদানকে অস্বীকার করার অর্থই ইতিহাসকে বিকৃত করা। বহু সমালোচিত হলেও তিনি তিনি যে এক সময়ে প্রশংসা ভাজন হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, নীলদর্পন নাটকটি কে রচনা করেন? বাংলা নাট্যসাহিত্যে তার অবদান আলোচনা করো।
📘 👉🏻 বাংলা নাট্য সাহিত্যে মহেন্দ্রক্ষনের এক মেনু প্রান্তে দেখতে পায় উজ্জ্বল প্রতিভার সাক্ষর শ্রী মধুসূদন অপর মেরুতে দেখতে পায় দীনবন্ধু মিত্র। এই দুই নাট্য ব্যাক্তিত্ব বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, যার নাট্য সৃষ্টি দেশে ও বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল
তিনি ধীমান নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। তাই বাংলা নাট্য সাহিত্যে তাঁর নাটকগুলি হয়ে উঠেছে বাস্তব সমাজের দলিল।
● দীনবন্ধু মিত্রের সৃষ্ট নাটক :– দীনবন্ধু মিত্র বাংলা সাহিত্যে অনেকগুলি নাটক রচনা করেছিল, সেই নাটকগুলি হল–
- ‘নীলদর্পন’ (১৮৬০ খ্রি.)
- ‘কমলে কামিনী (১৮৭৩ খ্রি.)
- ‘নবীন তপস্বীনি’ (১৮৬৩ খ্রি.)
● দীনবন্ধু মিত্র রচিত প্রহসন গুলি হল :–
- বিয়ে পাগলা বুড়ো → (১৮৬৬ খ্রি.)
- জামাই বারিক → (১৮৭২ খ্রি.)
- লীলাবতী → (১৮৬৭ খ্রি.)
- সধবার একাদশী → (১৮৬৬ খ্রি.)
–এই নাটকগুলি দীনবন্ধু মিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
দীনবন্ধু মিত্রের রচনা নৈপুন্য :–
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র এক বাস্তবধর্মী নাট্যকার। ‘নীলদর্পন’ তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। এই নাটকখানি তিনি রচনা করেছেন এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। বঙ্গদেশে কৃষিজীবী মানুষের উপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে। নীলকর সাহেবদের অমানসিক অত্যাচারের এক স্বচ দর্পন হল নীলদর্পন। ‘নীলদর্পণ’ একটি Tragedy নাটক। তবে এই নাটকখানি তেমন সার্থকতা লাভ করতে পারেনি। এক সম্পূর্ণ গৃহস্থ গোলক বসু ও সাধুচরন নামে একসাধারন প্রজার শোকবহ পরিনাম এখানে বর্ণিত হয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্র প্রহসন রচনাতেও সিদ্ধ হস্ত। এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ প্রহসনে এক বৃদ্ধের বিবাহের বিড়ম্বনা হ্রাস্যকর অসৎঙ্গতির মধ্য
দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। জামাই বারিক প্রহসনে নাট্যকার ধনীসমাজের ঘরজামাই এর প্রথাকে নিদারুনভাবে ব্যাঙ্গ করেছেন।
পরিশেষে বলতে হয়ে বাংলা নাট্য-সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র এক উজ্বল ব্যক্তিত্ব। তিনি চেয়েছিলেন সমাজের অত্যাচার অনাচার এবং ক্লেদাক্ত রূপটিকে ফুটিয়ে তুলতে।
তাই সমাজের দলিল হিসাবে আমরা তাঁর হাত থেকে কেবল নাট্য চিত্রই পেয়েছি। সেইজন্য বাংলা নাট্য সাহিত্যে তাঁর অবদান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণীয়।
বাংলা কাব্যে নজরুল ইসলামের অবদান আলোচনা করো।
📘 👉🏻 বাংলা সাহিত্যে যে কবি পালা বদলের গান শুনিয়েছেন, লিখেছেন নতুন যুগের ঠিকানা তিনি বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম। তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল বিদ্রোহের রনতুর্য বাজিয়ে। নামে বিদ্রোহী হলেও হলেও তিনি ছিলেন মুলত মানবতাবাদের কবি, নবীন যৌবনের পূজারী, মানুষকে কেন্দ্র করেই তাঁর আবেগ উদ্দিপনা ও আর্তনাদ। তিনি ছিলেন সত্য, বিবেক, মূল্যবোধ ও মানবতার অতন্দ্র প্রহরী।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :– ১৮৯৯ খ্রীঃ বর্তমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কবি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলবি ফকির আহমেদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন।
● কাব্যগ্রন্থ :– নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অগ্নিবীণা” প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ‘দোলনচাপা’ (১৯২৩ খ্রী.) ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪ খ্রীঃ), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫ খ্রী.), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬ খ্রী.), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭ খ্রী.), ‘বুলবুল’ (১৯২৮ খ্রী.) প্রভৃতি।
বিদ্রোহীভাবনা :– সামাজিক কুসংস্কার, পৌরুষহীন, স্থবিরতা, জড়ত্ব এবং অত্যাচারির অন্যায়-অত্যাচার-শোষন ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে কবি চির বিদ্রোহী ও অপোষহীন সংগ্রামী। তাই ‘বিদ্রোহী কবি’ কবিতায় বললেন,—
"আমি সেইদিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা অত্যাচারীর মড়গ কৃপান ভীন রণভূমে রণিবে না।”
সমাজ চিন্তা :– কবি জানেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেই সমাজ শাসক চালিয়ে যায় অত্যাচার। তাই তিনি জাতপাতের ভেদাভেদের শিকড় ধরে দিয়েছেন টান। ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় কবি লিখেছেন,–
"হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?”
পরিশেষে বলতে হয়, নজরুলের কবিতায় মূল উপাদান শ্রেনী সচেতনতা ও সাম্যচেতনা। স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে পরাধীন জড়তাগ্রন্থ সমাজের বুকে সঞ্চার করেছিলেন নবযৌবনের শোনিত ধারা। তিনি একদিকে সৌন্দ্ররের বীণা অন্যদিকে তরবারির ঝঞ্ঝনানি এবং মধ্যাহ্নের রনতুর্য তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান উল্লেখ করো।
📘 👉🏻 উনবিংশ শতাব্দীর প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর বিদ্যাসাগর মহাশয়। তিনি প্রকৃত অর্থেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং রামমোহনের হাতের নাবালক বাংলা গদ্যকে সাবালকত্ব দান করতে পেরেছেন। তার হাত দিয়েই বাংলা গদ্যের যৌবন মুক্তি ঘটেছে।
বিদ্যাসাগরের রচনাবলী কে আমরা দুই ভাগই ভাগ করতে পারি। একটি হলো অনুবাদধর্মী এবং অপরটি হল মৌলিক রচনা।
অনুবাদ :— বিদ্যাসাগরের সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনুবাদের হাত ধরে। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত তিনি অনেকগুলি পুস্তক অনুবাদ করেছিলেন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেও ‘কৃষ্ণকথা’ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বাসুদেব চরিত’। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থটি, এটি বিদ্যাসাগরের প্রথম রচনা। এরপরে তার দ্বিতীয় গ্রন্থটি ‘শকুন্তলা’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে, এটি কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের স্বচ্ছন্দ গদ্যানুবাদ। ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘সীতার বনবাস’। শেক্সপিয়রের *কমেডি অফ এররস* (Comedy of Errors) অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘ভ্রান্ত বিলাস’, মার্শম্যান সাহেবের *হিস্টরি অফ বেঙ্গল* (History of Bengal) অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘বাংলার ইতিহাস’। ঈশপের *ফেবল* (Fable) অবলম্বনে তার প্রখ্যাত রচনা ‘কথামালা’।
মৌলিক রচনা :– বিদ্যাসাগর বেশকিছু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা ব্যাকরনের ‘বর্ণপরিচয়’ আজও শিশুদের অদ্বিতীয় পাঠ্য। তাঁর ‘ব্যাকরণ কৌমুদি’ সংস্কৃত ব্যাকরনের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ এবং ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’, তিনি “কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য সহচরস্য” ছদ্মনামে লিখেছিলেন ‘অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’ ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে হয় যে, বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সর্বপ্রথম সুষম পরিকাঠামো দান করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলা পদ্যের শ্রী এবং হ্রী দান করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের পূর্বে বাংলা গদ্য ছিল আরবী, ফার্সী এবং ইংরাজী ভাষার নকলমাত্র। সেখানে বাঙালীর স্পন্দিত হয়নি। বিদ্যাসাগর প্রকৃতিই ছিলেন নির্মাণ শিল্পী। তাই তাঁর হাতের পরিকাঠামো স্বচ্ছ, সাবলীল এবং সুন্দর হয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের সার্থক শিল্পী বলে সম্মানিত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে ‘ভোরের পাখি’ বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান উল্লেখ করো।
📘 👉🏻 আধুনিক বাংলা কাব্যে গীতি কবিতার জনক হিসাবে বিহারীলাল চক্রবর্তীকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যলগ্নে তাঁর
কণ্ঠেই শোনা গিয়েছিল প্রথম গীতি কবিতার সুর মুর্ছনা। তাই রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন “ভোরের পাখি”।
■ গীতিকবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন “গীতের যা উদ্দেশ্য কোনো কবিতা যদি সেই উদ্দেশ্য পালন করে তবে তা গীতিকবিতা। আধুনিক মতে, কবিমনের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছ্বাসের বিকাশ যদি কবিতার মধ্যে ঘটে এবং সেই কবিতা থেকে যদি গীতি মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ে, তবেই তাকে গীতি কবিতার জনক বলে। কারন তিনিই প্রথম আধুনিক কবি, যিনি আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসকে প্রথম অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন–
"হে যোগেন্দ্র যোগাসনে ঢুলু ঢুলু নয়নে- কীহারে ধেয়াও।"
এই আত্মা অনুসন্ধানে তিনি কখনই ছুটে গেছেন ব্রহ্মার মানস সরবরে দেবী ভারতকে উপলব্ধি করতে। আবার কখনও বাল্মিকীর কালে সরস্বতীর সাধনায় মগ্ন হয়েছেন। এই আত্ম অনুসন্ধানে তিনি নিজের ঠিকানা খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে ‘সাধের আসন’ কাব্যে তিনি পুনরায় বলে উঠেছেন–
"কাহারে ধেয়াই দেবী আমি নিজে সে জানি নে।”
কাব্যগ্রন্থ :— বিহারী লালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল ‘স্বপ্ন দর্শন’ (১৮৫৮ খ্রী.)। তারপরে ক্রমশ তাঁর একাধিক কাব্যে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এগুলির মধ্যে ‘সঙ্গীত শতক’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘বন্ধুবিয়োগ’, ‘সারদামঙ্গল’, ‘সাধের আসন’, ‘বাউল বিংশতি’ প্রভৃতি কাব্যগুলি তার রচনা সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিহারীলালের ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে, গৃহনারিদের কল্যানময় রূপ বর্ণিত হয়েছে। আমাদের বঙ্গসংসারে রমনীদের জননী, জায়া ও কন্যারূপে ভজনা করে তাদের ইন্দ্রানী তুল্য করে গড়ে তুলেছেন। সারদামঙ্গলে আছে কবির আত্ম জিজ্ঞাসা। দেবী সারদা কখনও তার কাছে হয়ে উঠেছেন দেবী, কখনও কন্যা, আবার কখনও প্রেয়সী। এই কাব্যে কবির মনে জেগে উঠেছে হতাশার শূন্যতা। তাই প্রেম সম্পর্কে হতাশ কবি বলে উঠেছেন–
"তবে কী সকলই ভুল নাই কী প্রেমের মূল্য? বিচিত্র গগন ফল কল্পনা তার"
পরিশেষে বলতে হয়, বিহারীলালের “সাধের আসন” কাব্যে নারিকে মাতৃ মুর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। মহীয়সী নারির আদর্শকে তিনি কল্পনায় কল্পলোকে অঙ্কন করেছেন। তবে ভাবের দিক থেকে তিনি যে নতুনত্বের দিশারী সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলা সাহিত্যের ছোটো গল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান আলোচনা করো।
📘 👉🏻 বহুমুখী প্রতিভার আশীর্বাদ ধন্য বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বাংলা সাহিত্যের সার্থক ছোটগল্পের স্রষ্টা। তিনি জমিদারি উপলক্ষে পদ্মা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে যখন বসবাস করছিলেন তখন তিনি বাস্তব সংসারে নানাবিদ মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সে সময় সাধারণ মানুষের সাথে হৃদয়ে হৃদয় যোগ করে জীবনে জীবন যোগ করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা রক্তরাগে ফুটে উঠেছে তার ছোট গল্পগুলিতে। সেই ছোট গল্পগুলি হল– ‘দেনাপাওনা’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘কঙ্কাল’, ‘একরাত্রি’, ‘জীবমৃত’ প্রভৃতি।
দেনাপাওনা :– ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নায়িকা নিরুপমা যে রামসুন্দর বাবুর আলালের দুলালি অন্যদিকে সে আবার জমিদার রায়বাহাদুর সাহেবের পুত্রবধূ। সমাজের কুপ্রথা তথা পণ প্রথার কবলে নিরুপমার শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছিল। বলা যেতে পারে এই গল্পে সামাজিক পণপ্রথার বিষবাষ্পের জর্জরিত অত্যাচারিত নারী সমাজের প্রতিবাদ হীন নিরব প্রতিনিধি নিরুপমা।
কাবুলিওয়ালা :– রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে একটি দুষ্প্রাপ্য গোলাপ কাবুলিওয়ালা। সুদূর কাবুল দেশ থেকে তার পাপড়ি মিলেও দেশকালের বেড়াজাল অতিক্রম করে বাংলাদেশের বুকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তার দেহসৌরভ এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ চিরন্তন পিতৃস্বত্বার জয়গান ঘোষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন সেই পিতৃস্বত্বার শাশ্বত রূপ যা ভাষা-ধর্ম-বর্ণ দেশকালের সংকীর্ণতা অতিক্রম করে চিরন্তন মানব হৃদয়ে প্রবাহিত।
মধ্যবর্তিনী :– রবীন্দ্রনাথ ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পে প্রেম মনস্তত্ত্বের মায়াজাল বিছিয়ে মানব সংসারে সাধারণ মানব-মানবীর অন্তর উৎসারিত প্রেমের মিষ্টি শিহরণ তুলে ধরেছেন। সংসার জীবনে নরনারীর ভালবাসা যে ইন্দ্রধনূর মায়াজাল সৃষ্টি করে তারই সত্যরূপটি লেখক এই গল্পে তুলে ধরেছেন।
পরিশেষে বলতে হয় ছোটগল্প রচনায় রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধহস্তা গল্পকার। তার প্রতিভার ইন্দ্রজাল প্রয়োগে যে শিল্পনৈপুণ্য সৃজন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
📘 লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক 📘
ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ কর।
📘 👉🏻 ছড়া হল বাংলা সাহিত্যের একটি লৌকিক ও ছন্দময় রূপ, যা সাধারণত সহজ ভাষায় রচিত হয় এবং লোকমুখে প্রচলিত। এটি আনন্দদায়ক, কৌতুকপূর্ণ ও শিক্ষামূলক হতে পারে। ছড়ার মূল বৈশিষ্ট্য হলো ছন্দ ও অন্ত্যমিল, যা একে গীতিময় করে তোলে। এটি মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত হলেও সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটায়। অর্থাৎ মুখে মুখে রচিত অন্ত্যমিল যুক্ত ছোট আকারের গদ্যকে সাধারণত বলা হয় ছড়া। এগুলি মূলত ২,৪,৬,৮ চরণে নির্মিত।
● ছড়ার বৈশিষ্ট্য :–
- ১. ছন্দ ও অন্ত্যমিল – ছড়ার প্রধান আকর্ষণ হলো এর ছন্দ ও অন্ত্যমিল, যা সহজেই মুখস্থ করা যায়।
- ২. সরল ভাষা – ছড়ার ভাষা সহজ, সোজাসাপ্টা ও সাবলীল হয়, যা ছোটদের জন্য উপযোগী।
- ৩. আনন্দদায়ক ও কৌতুকপূর্ণ – ছড়ার মধ্যে হাস্যরস ও কৌতুকের উপাদান থাকে, যা শিশুদের মনোরঞ্জন করে।
- ৪. উপদেশমূলক ও শিক্ষামূলক – অনেক ছড়ার মাধ্যমে নীতিকথা, নৈতিকতা ও সাধারণ জ্ঞান শেখানো হয়।
- ৫. লোক-সংস্কৃতির প্রতিফলন – ছড়ায় গ্রামবাংলার জীবনধারা, কৃষি, ঋতু ও সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটে।
- ৬. খেলার উপযোগী – অনেক ছড়া শিশুরা খেলার সময় গাইতে পারে এবং তা খেলাধুলার নিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
- ৭. ধ্বনিগত সৌন্দর্য – ছড়ার মধ্যে অনুপ্রাস, অলংকার ও ধ্বনির আকর্ষণীয় ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
- ৮. প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচলিত – ছড়া সাধারণত লোকমুখে প্রচারিত হয় এবং মৌখিকভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
- ৯. ছোট পরিসরে গভীর ভাব প্রকাশ – ছোট ছড়ার মধ্যেই কোনো একটি গভীর বার্তা বা জীবনবোধ তুলে ধরা হয়।
- ১০. মৌখিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা – ছড়াগুলো সাধারণত মুখে মুখে প্রচারিত হয় এবং সহজে মানুষের মুখস্থ হয়ে যায়।
● ছড়ার উদাহরণ :–
১. বর্ণপরিচয়মূলক ছড়া :– এ ধরনের ছড়ার মাধ্যমে শিশুদের বাংলা বর্ণমালা শেখানো হয়। উদাহরণ–
*অ-এ অজগর আসছে তেরে
আ-এ আমটি খাবো পেরে*
২. হাস্যরসাত্মক ছড়া :– এ ছড়াগুলো কৌতুকপূর্ণ ও মজার হয়।উদাহরণ–
*কানার হাটবাজার, কানাইয়ের দোকান, বেচে শুধু বাতাস, তবু দেয় দাম হাঁকান!*
৩. প্রবাদমূলক ছড়া :– এই ছড়াগুলো কোনো নীতিবাক্য বা জীবনের সত্য তুলে ধরে। উদাহরণ–
*যার সব ভালো, তার শেষ ভালো।*
৪. ঐতিহ্যবাহী বা ধর্মীয় ছড়া :– ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেব-দেবী বা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন এ ছড়ায় পাওয়া যায়। উদাহরণ–
*হরিধ্বনি হরিধ্বনি, বাজে সারা দেশে! যদি ভগবান থাকেন সাথে, দুঃখ সব ঘোচে শেষে!*
৫. গ্রাম্য জীবন ও কৃষিভিত্তিক ছড়া :– কৃষকের জীবন, ঋতু পরিবর্তন ও ফসলের চিত্র এ ধরনের ছড়ায় প্রকাশ পায়। উদাহরণ–
*ধান কাটার দিন এল রে ভাই, খেতের মাঝে নাচে সবাই! বৃষ্টি হলো, শস্য ফলল, গরু-মোষের হাসি ফুটল!*
ধাঁধা কাকে বলে? ধাঁধার বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ কর।
📘 👉🏻 ধাঁধা হলো ছন্দময়, রহস্যময় ও ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন বা বক্তব্য, যা শুনে বা পড়ে মানুষকে চিন্তা করে তার উত্তর বের করতে হয়। এটি বুদ্ধির পরীক্ষা নেয় এবং কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। ধাঁধা হলো বুদ্ধিভিত্তিক একটি সাহিত্যধারা, যেখানে কোনো বস্তু, ব্যক্তি বা ধারণাকে গোপন রেখে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় সেটি প্রকাশ করা হয়। এটি মনের সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। ধাঁধা অনেক সময় ছন্দবদ্ধ হয়ে থাকে এবং এর উত্তর খুঁজতে চিন্তার প্রয়োগ প্রয়োজন হয়।
● ধাঁধার বৈশিষ্ট্য :–
- ১. প্রচলন – ধাঁধাগুলি লোকমুখে প্রচারিত হয় এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে আসে। যদিও ধাঁধা মুখে মুখে ছড়ায়, তবু বহু প্রাচীন সময় থেকেই এগুলোর লিখিত রূপ পাওয়া যায়।
- ২. স্মৃতি – সহজ ও ছন্দময় হওয়ায় এটি সহজেই মুখস্থ করা যায় এবং বহুদিন ধরে স্মৃতিতে থাকে।
- ৩. অস্তিত্ব – ধাঁধার জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা একে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকিয়ে রাখে।
- ৪. সংক্ষিপ্ততা – দীর্ঘ বক্তব্যের পরিবর্তে ধাঁধা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য রূপ নেয়।
- ৫. সরস ও চমকপ্রদ – ধাঁধার মধ্যে কৌতূহল ও মজার উপাদান থাকে, যা সমাধান করতে আগ্রহী করে তোলে।
- ৬. প্রবাদরূপ – ধাঁধার গঠন অনেক সময় প্রবাদের মতো হয়, যা সমাজে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
- ৭. চিন্তনের প্রকাশ – ধাঁধাগুলো মানুষের সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রতিফলন ঘটায়।
- ৮. রহস্যময়তা – ধাঁধার মধ্যে রহস্য থাকে, যা সমাধানের জন্য বুদ্ধির
- প্রয়োগ প্রয়োজন হয়।
- ৯. ইঙ্গিতপূর্ণতা – ধাঁধায় সাধারণত ইশারা বা সংকেত থাকে, যা বুঝতে পারলে সহজেই উত্তর বের করা যায়।
- ১০. বাকচাতুর্য ও রূপকতা – ধাঁধায় শব্দ নিয়ে খেলা করা হয়, যেখানে এক বা একাধিক অর্থ গোপন থাকে।
● বাংলায় প্রচলিত কয়েকটি ধাঁধা ও উত্তর :–
উপরটা গোল, ভিতরটা ফাঁকা, হাজার লোককে খাওয়ায়, তবু থাকে আঁকা।
উত্তর: ঊনুন
২. মুখ নাই কথা বলে,
পা নাই হেঁটে চলে।
উত্তর: ঘড়ি
৩. আগে ছিলাম বেঁটে, এখন হলাম লম্বা, আগুন দিলেই পুড়ে মরি, বলো তো আমি কে বা?
উত্তর: মোমবাতি
৪. ছায়া ছাড়া শয় না, লাথি ছাড়া ওঠেনা।
উত্তর: কুকুর
৫. বাড়িতে আছে কাঠের গাই, বছর বছর দুধ খায়।
উত্তর: খেজুর গাছ
প্রবাদ ও প্রবচন কাকে বলে? প্রবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ কর।
📘 👉🏻 প্রবাদ ও প্রবচন উভয়ই বাংলা সাহিত্যের লোকসংস্কৃতির অংশ, যা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
প্রবাদ :– প্রবাদ হলো সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের প্রতিফলন, যা কোনো বিশেষ ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়েও সার্বজনীন সত্য প্রকাশ করে। এটি সাধারণত ছোট, অর্থবহ এবং গভীর বার্তাবাহী হয়ে থাকে।
প্রবচন :– প্রবচন হলো বিখ্যাত ব্যক্তি বা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত নীতিমূলক বক্তব্য, যা মানুষকে সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেয়। এটি সাধারণত কোনো ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় উৎস থেকে আসে।
রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রবাদ কথাটির মধ্যে একটি গল্পের ভাব রয়েছে, কিন্তু প্রবচন ছাঁটা-কাটা কথা মাত্র। যদিও বর্তমানে প্রবাদ ও প্রবচন প্রায়ই সমার্থক এবং পরিপূরক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
● প্রবাদের বৈশিষ্ট্য :–
- ১. সংক্ষেপ ও সরলতা – প্রবাদ সাধারণত ছোট ও সহজবোধ্য হয়, যা সহজেই মুখস্থ করা যায়।
- ২. গভীর অর্থবোধকতা – এটি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো গভীর জীবনবোধ বা নীতিবাক্য প্রকাশ করে।
- ৩. লোকজ অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত – মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে প্রবাদ সৃষ্টি হয়।
- ৪. মৌখিকভাবে প্রচলিত – প্রবাদ সাধারণত মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচলিত থাকে।
- ৫. উপদেশমূলক ও শিক্ষামূলক – অনেক প্রবাদের মধ্যে নৈতিকতা, সতর্কবাণী বা শিক্ষামূলক উপাদান থাকে।
- ৬. উদাহরণমূলক ব্যাখ্যা নেই – প্রবাদে কোনো বিশেষ ঘটনার উল্লেখ থাকে না, বরং এটি সার্বজনীন সত্যকে তুলে ধরে।
- ৭. কবিত্বময়তা ও ছন্দময়তা – অনেক প্রবাদের মধ্যে ছন্দ থাকে, যা সহজে মনে রাখা যায়।
- ৮. সার্বজনীনতা – এটি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সমাজের জন্য নয়, বরং সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য।
- ৯. গূঢ় অথচ সাধারণ অভিব্যক্তি – অনেক প্রবাদ সহজ ভাষায় বলা হলেও এর গভীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা থাকে।
- ১০. প্রচলিত জীবনধারার প্রতিফলন – সমাজের মূল্যবোধ, চিন্তাভাবনা ও রীতিনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রবাদ কাজ করে।
● প্রবাদের উদাহরণ ও অর্থ :–
১. অধিক লোভে তাঁতি নষ্ট।
অর্থ: অতিরিক্ত লোভ মানুষকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়।
২. যেমন কর্ম, তেমন ফল।
অর্থ: যে যেমন কাজ করে, সে তেমনই ফল পায়।
৩. লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
অর্থ: লোভ থেকে পাপ জন্ম নেয় এবং শেষ পর্যন্ত তা ধ্বংস ডেকে আনে।
৪. সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না।
অর্থ: সময় একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না, তাই সময়ের মূল্য দিতে হবে।
৫. আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
অর্থ: আগে নিজের জীবন রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৬. চোরের দশ দিন, গৃহস্থের এক দিন।
অর্থ: অন্যায়কারী কিছুদিন জিতলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের জয় হয়।
৭. নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।
অর্থ: অযোগ্য ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতার দোষ অন্যের ওপর চাপায়।
৮. সোনার পাথরবাটি।
অর্থ: অসম্ভব বা অবাস্তব কিছুকে বোঝাতে বলা হয়।
৯. অতিরিক্ত বুদ্ধি বিপদের কারণ।
অর্থ: অপ্রয়োজনীয় বুদ্ধি খাটানো অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করে।
১০. এক হাত তালি বাজে না।
অর্থ: কোনো ঘটনাতে একপক্ষই সবসময় দোষী নয়, উভয়ের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবাদ বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব শিক্ষা দেয়। এগুলো শুধু কথার কথা নয়, বরং সমাজের নীতি ও আদর্শের প্রতিচ্ছবি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -