‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধসংকলন, যেখানে লেখক তাঁর স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গ, রসবোধ ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
বই কেনা – বিষয়বস্তু
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি মূলত পাঠাভ্যাস, বই কেনার প্রয়োজনীয়তা এবং বাঙালির বই কেনার প্রতি অনাগ্রহ নিয়ে রচিত এক ব্যঙ্গাত্মক ও রসাত্মক রচনা। লেখক অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ও রসঘন ভাষায় বই কেনার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন এবং বই না কেনার নানা হাস্যকর অজুহাতের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন।
মাছির চোখ ও আনাতোল ফ্রাঁসের উপলব্ধি
প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক মাছি মারার কষ্টসাধ্যতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাছিকে ধরা কঠিন কারণ তার চারদিকে অসংখ্য চোখ রয়েছে, যার ফলে সে আশপাশের সবকিছু একসঙ্গে দেখতে পায়। এই প্রসঙ্গ ধরে তিনি আনাতোল ফ্রাঁসের একটি দার্শনিক উক্তি উল্লেখ করেন—
"হায়! আমার মাথার চারপাশে যদি চোখ থাকতো, তাহলে আমি পুরো পৃথিবীকে একই সময়ে দেখতে পারতাম।"
ফ্রাঁসের এই আক্ষেপ বোঝায়, মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তিনি আরও বলেছেন,
"কিন্তু আমার মনের চোখ তো মাত্র একটি বা দুটি নয়, আমি যত বেশি জ্ঞান অর্জন করি, ততই আমার মনের চোখ খুলতে থাকে।"
অর্থাৎ, মানুষের শারীরিক চোখের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়, তবে বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানের দৃষ্টি প্রসারিত করা সম্ভব। আর এই জ্ঞান আহরণের প্রধান উপায় হলো বই পড়া ও বই কেনা।
সংসারের যন্ত্রণা এড়ানোর উপায় ও বারট্রান্ড রাসেলের দৃষ্টিভঙ্গি
লেখক বারট্রান্ড রাসেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মত তুলে ধরেন—
"সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করা এবং বিপদকালে সেই ভুবনের মধ্যে ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, সে তত বেশি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।"
এই নতুন ভুবন কীভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব? লেখকের মতে, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে মানুষ তার মানসিক জগত সমৃদ্ধ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যদি সাহিত্য সান্ত্বনা দিতে না পারে, তাহলে দর্শন পড়তে হবে, দর্শন কাজ না করলে ইতিহাস, ইতিহাস ব্যর্থ হলে ভূগোল—এভাবে একের পর এক বিষয় পাঠের মাধ্যমে মানুষ তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে।
ওমর খৈয়াম ও পবিত্র গ্রন্থগুলোর গুরুত্ব
ওমর খৈয়ামের একটি বিখ্যাত কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, জীবনের অনেক কিছুই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু একটি ভালো বই অনন্ত যৌবনা। তিনি বলেন,-
"রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু ভালো বই চিরকাল নতুন থাকে, যদি তা সত্যিই ভালো বই হয়।"
এছাড়া তিনি কোরআন, বাইবেল, গণেশের লেখা পুরাণ ইত্যাদির প্রসঙ্গ টেনে বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের জ্ঞান আহরণের অন্যতম মাধ্যম হলো বই।
বাঙালির বই কেনার প্রতি উদাসীনতা ও হাস্যকর অজুহাত
বাঙালির বই কেনার প্রতি আগ্রহহীনতা লেখককে ব্যথিত করে। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন,
"বাঙালি বলবে, অত কাঁচা পয়সা কোথায়, বাওয়া, যে বই কিনবো?"
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বাঙালির অর্থাভাব নেই। তারা ফুটবল ম্যাচ দেখতে কিংবা সিনেমার টিকিট কাটতে অনেক টাকা খরচ করলেও বই কেনার ক্ষেত্রে নানা অজুহাত খোঁজে। লেখকের মতে, যে জাতি বইয়ের মূল্য বোঝে না, সে জাতি পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। তিনি বইয়ের দাম নিয়ে আরেকটি সমস্যা তুলে ধরেন—
- বইয়ের দাম বেশি বলে লোকে বই কেনে না।
- আর লোকে বই কেনে না বলে বইয়ের দাম কমানো সম্ভব হয় না।
এটি এক অচ্ছেদ্য চক্র যা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
বই কেনার গুরুত্ব ও পাঠকের বিভিন্ন স্তর
লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না, বরং বই কিনলে মানুষ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়। তিনি পাঠকদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন—
- সংসারী পাঠক – যারা হিসাব করে বই কেনে।
- উৎসাহী পাঠক – যারা বই কিনে আনন্দ পায়।
- উন্মাদ পাঠক – যারা বই কেনার নেশায় পাগল হয়ে যায়।
তিনি বলেন, বই কেনার নেশা একমাত্র ভালো নেশা, যা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় না, বরং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে।
মার্ক টুয়েনের লাইব্রেরি ও বই ধার না দেওয়ার ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টান্ত
লেখক মার্ক টুয়েনের লাইব্রেরির গল্প উল্লেখ করেছেন—
"টুয়েনের লাইব্রেরি মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা ছিল, এমনকি কার্পেটের উপরও গাদা গাদা বই ছিল। এক বন্ধু তাকে শেলফ কেনার পরামর্শ দিলে তিনি বলেছিলেন, 'ভাই, শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার নেওয়া যায় না!'"
এর মাধ্যমে লেখক বাঙালির বই ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভ্যাসকেও ব্যঙ্গ করেছেন। তিনি বলেন, অনেকেই বই ধার নেন, কিন্তু ফেরত দেন না। অথচ তারা অন্য কোনো জিনিস ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে এতটা নির্লজ্জ হন না।
আঁদ্রে জিদের শিক্ষা
লেখক আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন—
ফরাসি সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ রাশিয়া থেকে ফিরে এসে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করে একটি বই লেখেন। তখন তার বন্ধুরা তাকে সমর্থন না করে নীরব থাকেন। জিদ এতে ক্ষুব্ধ হন এবং শিক্ষা দিতে তার লাইব্রেরির সমস্ত বই নিলামে তোলেন।
কিন্তু চতুরতার সঙ্গে তিনি শুধু সেইসব বই নিলামে তোলেন, যেগুলো তার বন্ধুরা তাকে উপহার দিয়েছিলেন।ফলাফল, অপমানিত লেখকরা দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে নিজেদের বই ফেরত কেনেন!
এ ঘটনা বোঝায়, বই শুধু জ্ঞানের বাহন নয়, এটি অপমান করার ও প্রতিশোধ নেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যমও হতে পারে।
রাজা ও হেকিমের গল্প – বই থেকে ভয় পাওয়া!
শেষ অংশে লেখক একটি আরব্য রূপকথা উল্লেখ করেছেন— এক রাজা একজন হেকিমকে হত্যা করে তার একটি গোপন বই সংগ্রহ করেন। কিন্তু বইটির পাতাগুলো ছিল বিষ মাখানো। তাই রাজা বই পড়তে পড়তে বিষক্রিয়ায় মারা যান।এরপর লেখক ব্যঙ্গ করে বলেন—
"বাঙালির বই কেনার প্রতি যে ভয়, তা দেখে মনে হয় তারা যেন এই গল্পটা জানে! তারা ভাবে, বই কিনলেই বুঝি ক্ষতি হয়ে যাবে!"
উপসংহার
‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি কেবল বই কেনার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্যই নয়, বরং বাঙালির বই না কেনার মানসিকতাকে ব্যঙ্গ করার জন্যও লেখা হয়েছে। লেখক যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, বই কেনা মানেই অপচয় নয়, বরং এটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার শ্রেষ্ঠ উপায়। তিনি পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেছেন, যত বেশি বই পড়বে, তত বেশি নতুন ভুবন সৃষ্টি হবে, ততই জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -