‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধটি সৈয়দ মুজতবা আলীর জনপ্রিয় প্রবন্ধসংকলন ‘পঞ্চতন্ত্র’ (১৯৫২) গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে সাহিত্য, সংগীত, দর্শন, রাজনীতি এবং জীবনবোধ নিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও মননশীল রচনাগুলি সংকলিত হয়েছে। ব্যঙ্গ-রসাত্মক অথচ গভীর অর্থবহ ভাষায় লেখা এই প্রবন্ধগুলিতে লেখকের মৌলিক চিন্তাধারা প্রকাশ পেয়েছে।
‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য, সংগীত ও দর্শনের উপর তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা যেমন এতে প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীরতা ও সার্বজনীনতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ প্রবন্ধসংকলন হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু
সৈয়দ মুজতবা আলির লেখা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার বিশ্লেষণ। লেখক এখানে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম, সংগীত প্রতিভা এবং তাঁর অবদানকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রতি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা
মুজতবা আলি রবীন্দ্রনাথকে একাধারে এক শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, কবি, গবেষক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন—
- উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথ উৎকৃষ্ট উপন্যাস লিখেছেন।
- ছোটগল্প: ছোটগল্পে তিনি মপাসাঁ ও চেখভকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
- নাটক: নাটকে তিনি যে-কোনো মিস্টিক নাট্যকারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
- কবিতা: কবি হিসেবে তিনি বিশ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন।
- শব্দতত্ত্ব: তাঁর শব্দতত্ত্ব গবেষণা এত গভীর যে পণ্ডিতরাও বিস্মিত হয়েছেন।
- রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি: তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ভারতবাসীকে যুগে যুগে নতুন শিক্ষা দেবে।
- শিক্ষাব্রতী: শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিশ্বমানবতার জন্য এক স্নিগ্ধ আশ্রয় তৈরি করেছেন।
তবে, এসব গুণের পরও লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ চিরকাল তাঁর গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
রবীন্দ্রনাথের গানের মহিমা
মুজতবা আলি মনে করেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধারণ কোনো গান নয়, বরং এক সম্পূর্ণ রসলোকে পৌঁছে দেয়। তাঁর মতে—
- রবীন্দ্রসঙ্গীত কখনো অসম্পূর্ণ মনে হয় না। সাধারণ লীডার বা গজল শুনে মনে হয়, যদি গানটি আরও দীর্ঘ হতো, তবে ভালো লাগত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান শুনে অতৃপ্তি হলেও সেটি অসম্পূর্ণতার জন্য নয়, বরং উচ্চাঙ্গের রসের গভীরতা ও ব্যঞ্জনার কারণে।
- তাঁর গানের প্রতিটি শব্দ অপরিবর্তনীয়। গান শেষ হলেও তার রেশ হৃদয়ে থেকে যায়। লেখক এর তুলনা করেছেন নটরাজের নৃত্যের সঙ্গে—যেমন নটরাজের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি অনন্য, তেমনই রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি শব্দ ও সুরও নিখুঁত।
- তাঁর গান একদিকে স্বর্গীয়, অন্যদিকে মর্ত্যের বাস্তবতার সঙ্গে মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ কখনো আমাদের স্বর্গীয় ভাবনায় ভাসিয়ে নেন, আবার পৃথিবীকেও নতুনভাবে উপলব্ধি করান।
- শব্দ ও সুরের নিখুঁত সংমিশ্রণ: রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দচয়ন ও সুরের সংস্থাপন এতটাই নিখুঁত যে, মনে হয় এটি আর কোনো ভিন্ন রূপ নিতে পারত না।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যঞ্জনা
লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথের গান কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে
না। প্রতিবার শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন নতুন রূপ উন্মোচিত হয়। তাঁর গান শুনে মনে হয়—এটি আমাকে এক নতুন জগতে নিয়ে গেছে, কিন্তু এই জগতের সবটুকু এখনো জানা হয়নি। তাই এটি বারবার শোনার তীব্র আকর্ষণ তৈরি করে।
রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের একদিকে স্বর্গীয় ভাবনায় নিমগ্ন করে, আবার মর্ত্যলোকের বাস্তবতাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করায়। যেমন—
- “তারায় তারায় দীপ্তিশিখার অগ্নি জ্বলে নিদ্রাবিহীন গগনতলে” শুনে মনে হয় এক স্বর্গীয় আলোর জগতে চলে গেছি।
- কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের পৃথিবীর সৌন্দর্যের দিকে নিয়ে আসেন—
"হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে, শ্যামল মাটির ধরাতলে।"
এই দুই জগতের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অবিরত আনাগোনা করান। তাঁর গান মানুষকে দেবতার মতো পবিত্র করে তোলে, আবার দেবতার চেয়েও মহান মানবিক সত্তায় উন্নীত করে।
সৈয়দ মুজতবা আলির মতে, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার অনেক দিক থাকলেও তাঁর গানই তাঁকে চিরকাল অমর করে রাখবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত কখনো নিঃশেষ হয় না, প্রতিবার শুনলে তার নতুন রূপ ধরা দেয়, আর এভাবেই সে আমাদের চিরন্তন সম্পদ হয়ে ওঠে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -